ঐক্য ভাঙনেই প্রত্যাবর্তনের রাস্তায় আওয়ামী লীগ

ঐক্য ভাঙনেই প্রত্যাবর্তনের রাস্তায় আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন: ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়ানোর পেছনে দায় কার?

ইরানি কবি ওমর খৈয়ামের বিখ্যাত পঙ্‌ক্তি—”নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক”—হাজার বছর পর যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া আওয়ামী লীগ এখন আবার ধীরে ধীরে রাজনীতির মঞ্চে ফিরে আসছে। বিচ্ছিন্ন ঝটিকা মিছিল দিয়ে শুরু হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মিছিলগুলোতে উপস্থিতি বাড়ছে। প্রশ্ন জাগে—গণধিকৃত আওয়ামী লীগের এই প্রত্যাবর্তনের সুযোগ করে দিচ্ছে কারা?

৫ আগস্টের পর দলনেত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রথম সারির বেশিরভাগ নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। যারা পালাতে পারেননি, তারা আত্মগোপনে চলে যান। অথচ, দলটির দ্বিতীয় সারির নেতাকর্মীরা বিএনপি, জামায়াত এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়ে আবার সংগঠিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠছে।

অন্তর্বর্তী সরকার যদিও মুখে ফ্যাসিবাদবিরোধী কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে, বাস্তবে প্রশাসনে এখনো হাসিনার অনুগত আমলারা শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। এমনকি রেন্টাল প্রকল্পের বিল দ্রুত পরিশোধ করে সেখান থেকে পাওয়া অর্থ ব্যবহার হচ্ছে আওয়ামী লীগের মিছিলগুলোতে।

অন্যদিকে, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মতো অভ্যুত্থানকালীন ঐক্যজোট নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসনের সুযোগ দিচ্ছে। কেউ বলছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চাই; কেউ বলছেন, রমজানের আগে চাই; কেউ আবার মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মানছেন না—তাদের এসব দাবির মধ্যে জাতীয় স্বার্থ বা গণতন্ত্রের প্রশ্নটা আজ আর স্পষ্ট নয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্রদের ঐক্য ছিন্ন হয়ে নতুন দল গঠনের চেষ্টায় মাঠের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়েছে। আওয়ামী লীগ বুঝে গেছে বিএনপি তাদের প্রতিরোধ করবে না। জামায়াতের অবস্থান সর্বদা অনির্দেশ্য। প্রশাসনিক পদে নিয়োগ, চাঁদাবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় অভ্যুত্থানকালীন ঐক্য তলিয়ে যাচ্ছে, আর সেই সুযোগেই আওয়ামী লীগ ফের সক্রিয় হচ্ছে।

হাসিনার ভারতে অবস্থানকালে একের পর এক অডিও বার্তায় উসকানি, দেশে ফেরার হুমকি, আবার ফিরে না আসা—সব কিছু যেন “বেদের মেয়ে জোসনা”র মতো নাটকীয়। এই প্রেক্ষাপটে দিল্লির আনুগত্যশীল কিছু গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক বলয়ের সহায়তায় তার দল আবার মাঠে নামছে।

তথ্য অনুযায়ী, বিএনপির বিভিন্ন জেলা ও মহানগর পর্যায়ের নেতারা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আশ্রয় দিয়েছেন। দলের ভেতরে এ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হলেও এখনো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ‘লেনদেনমূলক মিছিল’ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এনসিপিও মুখে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করলেও বাস্তবে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীকে দলে টেনে নিচ্ছে। জামায়াতও কখনো দিল্লিকে, কখনো অন্যদের খুশি করতে কৌশল পরিবর্তন করছে।

এই বিভাজনের মধ্যে আওয়ামী লীগ রাজনীতির মঞ্চে ফিনিক্স পাখির মতো ফিরে আসছে। যদিও দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব বিদেশে পালিয়ে রয়েছে, দেশে থাকা বিপুল সংখ্যক কর্মী-সমর্থক আজও সক্রিয়। পুলিশ-প্রশাসনের ‘নরম নির্দেশনা’ এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির ঐক্যের অভাব তাদের সাহস জুগিয়েছে।

রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আওয়ামী লীগ ঝটিকা মিছিল করেছে। এসব মিছিলে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের দাবি এবং সরকারবিরোধী স্লোগান তুলেছে। এভাবে চলতে থাকলে আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান ফেসবুকে লিখেছেন, “দিন যত যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের মিছিল তত দীর্ঘ হচ্ছে। যদি ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে অন্তত ন্যূনতম বোঝাপড়া না হয়, তাহলে আওয়ামী লীগকে ঠেকানো যাবে না। কারণ এটি কোনো ছোট শক্তি নয়।”

এটাই বাস্তবতা—বিভাজন, দলীয় স্বার্থ এবং নগদবান্ধব রাজনীতির ফাঁকফোকর দিয়ে আওয়ামী লীগ আবার ফিরে আসছে। যদি ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান-সৃষ্ট ঐক্য নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে না উঠতে পারে, তবে ফিনিক্স পাখির মতো আওয়ামী লীগ আবার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসবে—এটা কেবল সময়ের অপেক্ষা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *