বিশ্বের লাইটহাউস হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস

বিশ্বের লাইটহাউস হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস
ক্ষুদ্রঋণ, সামাজিক ব্যবসা, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, দারিদ্র্যবিমোচন, তারুণ্যের নেতৃত্ব ও উদ্ভাবনী কাজে লাগানোর মতো তাঁর অনেক দর্শন ও চিন্তা বিশ্বকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিচ্ছে

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, বিশ্বব্যাপী পরিচিত এক শান্তিতে নোবেলজয়ী কৃতী সন্তান। তিনি বাংলাদেশের একমাত্র ‘গ্লোবাল সেলেব্রিটি’ এবং অর্থনীতিবিদ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। ৮৪ বছর বয়সেও তারুণ্যে ভরপুর এই মানুষটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি যা গবেষণা করেন, তা মাঠে বাস্তবায়ন করেন। বিশ্বের একমাত্র শিক্ষাবিদ যিনি তাঁর চিন্তাধারা বাস্তবে সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন। ক্ষুদ্রঋণ, সামাজিক ব্যবসা, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, দারিদ্র্য বিমোচন, তারুণ্যের নেতৃত্ব এবং উদ্ভাবনী কার্যক্রমের মাধ্যমে তাঁর বহু দর্শন ও চিন্তা বিশ্বের প্রগতির পথ সুগম করছে।

গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর, বাংলাদেশের এক সংকটময় মুহূর্তে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দায়িত্ব গ্রহণের আগে থেকেই তিনি জাতিকে ঐক্যের ডাক দেন। প্যারিস থেকে ঢাকার বিমানবন্দরে নেমেই বলেছিলেন, “গোটা বাংলাদেশ এক পরিবার হয়ে উঠবে।” এরপর ৮ আগস্ট বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যে কোনো সংকটে তিনি সর্বদা ঐক্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। গণ অভ্যুত্থানের পর যখন দেশের ভিতরে ও বাইরে প্রতিবিপ্লব এবং নানা ষড়যন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, তখনই তিনি ধর্ম, বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে সবাইকে একত্রিত করে ঐক্য বজায় রেখেছেন। রাষ্ট্রক্ষমতার কোনো দাম্ভিকতা তার ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি। তিনি এমন একজন সাধারণ গুণী মানুষ, যার অসাধারণ কৃতিত্ব রয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে শুরু হলেও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি নানা সেক্টরে তার মেধার প্রমাণ রেখেছেন, এবং এর ফলে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। সম্প্রতি তিনি ‘নেশন বিল্ডার’ উপাধি পেয়েছেন।

নেশন বিল্ডার: গণ অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি ‘নেশন বিল্ডার’ উপাধিতে ভূষিত হন। ৭ ডিসেম্বর, বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার তাকে এই উপাধি প্রদান করে। নেচার তার সেরা ১০ ব্যক্তিত্বের তালিকায় ৭ নম্বরে স্থান দিয়েছে, যাদের ২০২৪ সালে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরকারপ্রধান হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। এরপর তাঁর নেতৃত্বে রাষ্ট্র সংস্কারের চেষ্টা চলছে। নেচার এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছয় দশকের কর্মজীবনে ড. ইউনূস দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য নতুন ধারণা পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর কাজের মূল ভিত্তি হচ্ছে গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী সমস্যার সমাধান করা।

প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তি: সম্প্রতি, বিশ্বের প্রভাবশালী মুসলিমদের মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম স্থান পেয়েছে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের প্রভাব ও অবদান পর্যালোচনা করে ‘দ্য মুসলিম ৫০০: দ্য ওয়ার্ল্ডস ৫০০ মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল মুসলিমস’ তালিকা প্রকাশিত হয়, যেখানে ৫০ নম্বরে রয়েছেন তিনি।

ওয়ার্ল্ড ফুটবল সামিট অ্যাওয়ার্ড: ক্রীড়াজগতে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০২৩ সালে ওয়ার্ল্ড ফুটবল সামিট (ডব্লিউএফএস) থেকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ১১ ডিসেম্বর, সৌদি আরবের জেদ্দায় এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

চ্যাম্পিয়ন অব গ্লোবাল চেঞ্জ: ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের ‘চ্যাম্পিয়ন অব গ্লোবাল চেঞ্জ’ পুরস্কার পান শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নিউইয়র্কে আয়োজিত ‘উই দ্য পিপলস’ অনুষ্ঠানে তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।

অলিম্পিক লরেল অ্যাওয়ার্ড: ২০২১ সালে শিক্ষা, সংস্কৃতি, উন্নয়ন ও শান্তিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অলিম্পিক লরেল পুরস্কারে ভূষিত হন। টোকিও অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।

গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড: ২০১৯ সালে, ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন।

প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম: ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার এবং ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম লাভ করেন ড. ইউনূস।

নোবেল শান্তি পুরস্কার: ২০০৬ সালে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন, যা তাঁকে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে প্রদান করা হয়।

পিফার শান্তি পুরস্কার: ১৯৯৪ সালে, গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের স্বীকৃতি হিসেবে ড. ইউনূসকে যুক্তরাষ্ট্রের পিফার শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়।

কের পুরস্কার: ১৯৯৩ সালে দরিদ্র নারী ও পুরুষদের ক্ষমতায়নের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কেয়ার পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

মুহাম্মদ সাহেবুদ্দিন বিজ্ঞান (সামাজিক অর্থনীতি) পুরস্কার: ১৯৯৩ সালে, সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য শ্রীলঙ্কা কর্তৃক মুহাম্মদ সাহেবুদ্দিন পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।

আগা খান অ্যাওয়ার্ড: ১৯৮৯ সালে, দরিদ্রদের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক হাউজিং প্রোগ্রাম ডিজাইন ও পরিচালনার জন্য জেনেভা-ভিত্তিক আগা খান ফাউন্ডেশন পুরস্কার পান তিনি।

স্বাধীনতা পুরস্কার: ১৯৮৭ সালে, পল্লী উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক অ্যাওয়ার্ড: ১৯৮৫ সালে, গ্রামীণ ভূমিহীন জনগোষ্ঠীকে ঋণ প্রদানের জন্য একটি নতুন ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রণয়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ পুরস্কার দেন।

র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার: ১৯৮৪ সালে, ‘এশিয়ার নোবেল’ হিসেবে পরিচিত ‘র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার’ পান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *