হাতির সাহায্যে গাছ পাচার: বন উজাড়ের নেপথ্য কাহিনি

হাতির সাহায্যে গাছ পাচার: বন উজাড়ের নেপথ্য কাহিনি
টঙ্কাবতী বনাঞ্চলের গাছ কাটার পর হাতি দিয়ে তা খালের পাশে এনে রাখা হয়েছে। দৃশ্যটি ধারণ করা হয় গতকালের দুপুরবেলায়।

বান্দরবান সদর উপজেলার টঙ্কাবতী এলাকায় পাহাড়ের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল নির্বিচারে উজাড় করার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের দাবি, কাঠ পাচারকারীরা দুর্গম পাহাড়ের গাছ কেটে হাতির সাহায্যে রাস্তায় নামিয়ে এনে তা পাচার করছে। প্রায় তিন মাস ধরে হাতিসহ একটি চক্র সেখানে আস্তানা গড়ে বন উজাড় ও কাঠ পাচারের কাজে লিপ্ত রয়েছে।

জেলা শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে বান্দরবান-সুয়ালক-লামা সড়কের রঙ্গি খাল ধরে আরও প্রায় চার কিলোমিটার ভেতরে গেলে চিম্বুক রেঞ্জের সীতাপাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছানো যায়। সেখানেই জুংলাই পাড়ার কাছে বাঁশের তৈরি একটি অস্থায়ী ডেরা দেখা গেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গাছ কাটার শ্রমিকদের থাকার জন্যই এই ডেরা বানানো হয়েছে।

গতকাল শনিবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নির্জন বনের ভেতর বাঁশের তৈরি ঘরে পড়ে আছে শ্রমিকদের কাপড়চোপড়, রান্নার সরঞ্জাম ও হাতি বাঁধার দড়ি। তবে, সেই সময় ডেরায় কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে ফেরার পথে কয়েকজন কাঠশ্রমিকের সঙ্গে দেখা হয়, যাঁরা পাহাড়ের গভীরে গাছ কাটার কাজে ব্যস্ত ছিলেন।

কাঠশ্রমিক মো. বাদশা ও জসীম জানিয়েছেন, তাঁরা লোহাগাড়া উপজেলার নাফারটিলা গ্রামের আবদুর রহিমের নির্দেশনায় গাছ কাটার কাজ করেন। তাঁদের আস্তানার অবস্থান থেকে আরও দুই থেকে চার কিলোমিটার গভীরে পাহাড়ি বনাঞ্চলে কড়ই, শিউরি, গুটগুট্যা ও অন্যান্য প্রজাতির গাছ কাটা হয়েছে। দুটি হাতির মাধ্যমে গাছগুলো ট্রাক চলাচলের উপযোগী স্থানে এনে মজুত করা হয়। পরে রাতের আঁধারে ট্রাকে বোঝাই করে টঙ্কাবতী ও হাতির ডেরা সড়ক হয়ে নাফারটিলা ও লোহাগাড়ায় এসব কাঠ পাঠানো হয়। বর্তমানে এলাকায় দুটি বড় হাতি ও দুটি শাবক রয়েছে। রাতের বেলা হাতিগুলো আস্তানায় রাখা হলেও দিনের আলোয় বনাঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়।

আরেক কাঠশ্রমিক মোহাম্মদ বেলাল জানান, আবদুর রহিম নামে যিনি তাঁদের এই কাজে নিয়োগ করেছেন, তাঁর নামে টঙ্কাবতী মৌজার এক হাজার ঘনফুটের একটি জোত পারমিট রয়েছে। যদিও পারমিট টঙ্কাবতী মৌজার জন্য, বাস্তবে গাছ কাটা হচ্ছে টাকের পানছড়ি ও হরিণঝিরি মৌজার প্রাকৃতিক বনাঞ্চল থেকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেলাল বলেন, সাধারণত বাগানের গাছ বেশি কাটা হয়, তবে কিছু বনাঞ্চলের গাছও কাটা হয়। তাঁর ভাষায়, পারমিটের সেগুন ও গামারি গাছ দিয়ে এককভাবে ব্যবসায় লাভবান হওয়া কঠিন; তাই অনেক কাঠ ব্যবসায়ী অতিরিক্ত গাছ কেটে থাকেন।

টঙ্কাবতী এলাকার ম্রো সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রঙ্গি খাল ছাড়াও হরিণঝিরি ও টঙ্কাবতীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে জোত পারমিট দেখিয়ে বনাঞ্চলের গাছ কেটে নেওয়া হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে এবং এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে পানির উৎসে। পানির স্তর কমে যাওয়ায় চিম্বুক পাহাড় ও তার পাদদেশে বসবাসরত ম্রো জনগোষ্ঠী পরিবেশগত সংকটে পড়ছে।

বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের বান্দরবান জেলার সভাপতি জুয়ালিয়ান আমলাই জানান, জোত পারমিটের মাধ্যমে সরাসরি বনাঞ্চলের গাছ কাটার বৈধতা নেই। পারমিটের আওতায় কেবলমাত্র ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে রোপিত বাগানের গাছ কাটা অনুমোদিত। কোনো ব্যক্তি যদি বনাঞ্চলের গাছ আহরণ করেন, তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

এদিকে অভিযুক্ত লোহাগাড়ার গাছ ব্যবসায়ী আবদুর রহিম বনাঞ্চলের গাছ কাটার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, ব্যক্তিমালিকানাধীন জোত জমিতে কখনো কখনো বনজাতীয় গাছ থাকতেই পারে, আর বিক্রির প্রয়োজনেই সেগুলো কাটা হয়। দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থার কারণে হাতি দিয়ে গাছ পরিবহন করতে হয় বলে তিনি জানান।

টঙ্কাবতী রেঞ্জের বন কর্মকর্তা মো. রাফি উদ্দোল্লাহ জানান, হাতি দিয়ে গাছ টানার খবর তাঁর কানে এসেছে। তবে এলাকার দুর্গমতার কারণে সরাসরি হাতির অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, টঙ্কাবতী এলাকায় বেশ কিছু জোত পারমিট রয়েছে। কেউ যদি পারমিটের অপব্যবহার করে বনাঞ্চলের গাছ কেটে থাকে, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *