বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হলে কেন তা কখনো শেষ হতে চায় না?

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হলে কেন তা কখনো শেষ হতে চায় না
অনলাইন ছবি

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার নানা সমস্যা: একক পরীক্ষা না কি নিজস্ব পরীক্ষা?

এই লেখার শিরোনাম আরও নানা রকম হতে পারত। যেমন, ‘সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার সমস্যা কোথায়?’ কিংবা ‘ভর্তি–বাণিজ্য আর কত দিন চলবে?’ আবার অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকে শিরোনাম হতে পারত ‘লিখিত পরীক্ষা নিয়েও কেন লাভ হচ্ছে না?’ বা ‘এইচএসসির ফলের ভিত্তিতে ভর্তি নিতে বাধা কোথায়?’

শিরোনাম নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছি কারণ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু মানুষ ফোন করে ভর্তি পরীক্ষার নানা দিক নিয়ে মন্তব্য করছেন। অনেকেই জানতে চাইছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করতে এত দেরি কেন?

অভিভাবকদের দীর্ঘদিন ধরে দাবি ছিল সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার। ইউজিসি এ বিষয়ে কাজও করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে একক ভর্তি পরীক্ষায় রাজি করানো গিয়েছিল, এ বছর তাদেরও অবস্থান পাল্টাতে দেখা গেছে। তবে প্রশ্ন উঠছে, কেন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিতে চায়? এর সহজ উত্তর হতে পারে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ই চায় নিজের মতো প্রশ্নপত্র তৈরি করে সেরা শিক্ষার্থী নির্বাচন করতে। তবে এই যুক্তি খুব বেশি শক্তি পায় না, কারণ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র একত্রে দেখলে তা স্পষ্ট হয় যে, গুণগত মানে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই।

একক ভর্তি পরীক্ষার বিরোধিতার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আপত্তি এবং সমস্যা

একক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন আপত্তি রয়েছে। তাদের অভিযোগ, সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে অনেক সময় লাগে। কিন্তু একই সমস্যা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিয়েও হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণে অনেক সময়ের বেগ পেতে হয়।

এছাড়া, একক ভর্তি পরীক্ষা না হওয়ার ফলে আরেকটি সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো পরীক্ষার্থীর প্রথম পছন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়, তবে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল না আসা পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ভর্তির সুযোগ পেলেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল না আসা পর্যন্ত সেখানে ভর্তি হতে পারে না। যদি ভর্তি হয়ে যায়, তবে পরে সেখানে ভর্তি বাতিল করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে হয়।

এছাড়া, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী দেশের চারটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় এখনও একক পরীক্ষার বিপক্ষে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের ‘বড়’ মনে করলেও, ভর্তি পরীক্ষার জন্য সিজিপিএর ন্যূনতম যোগ্যতা খুব বেশি চায় না। এর ফলে, বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি চার বছর ধরে বহুনির্বাচনী প্রশ্নের পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষাও নিচ্ছে, তাতে ভর্তি পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করতে অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হচ্ছে।

লিখিত পরীক্ষা নিয়ে নানা সমস্যা: সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা প্রয়োজন

লিখিত পরীক্ষার পক্ষে অনেক যুক্তি থাকলেও, সেগুলো কার্যকর করতে হলে প্রশ্নগুলোও যথাযথ হতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের লিখিত পরীক্ষায় এমন প্রশ্ন দেখা যায়, যার সঙ্গে বহুনির্বাচনী প্রশ্নের বিশেষ পার্থক্য থাকে না। যেমন, এ বছর গ ইউনিটের প্রশ্নে এমন একটি প্রশ্ন ছিল: “সংশোধন করো: ‘পরিচ্ছদ মানে অধ্যায়, পরিচ্ছেদ মানে পোশাক’।” এখানে মূলত শব্দভাণ্ডার ও অর্থ বোঝার বিষয় যাচাই করা হয়েছে, যা বহুনির্বাচনী প্রশ্নেও করা সম্ভব ছিল।

লিখিত পরীক্ষা সফলভাবে পরিচালনা করতে গেলে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা সীমিত রাখতে হয়। কারণ, বিপুলসংখ্যক লিখিত খাতা মূল্যায়ন করতে গিয়ে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। পরীক্ষকভেদে অনেক সময় খাতায় নম্বরের বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়, যা কিছু পরীক্ষার্থীকে বাড়তি সুবিধা এবং অন্যদের ক্ষতি করে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এটি অগ্রহণযোগ্য, কারণ কখনো কখনো মাত্র ১ নম্বরের ব্যবধানেও মেধাক্রমের পার্থক্য হাজারের ওপর চলে যায়।

লিখিত খাতা মূল্যায়নে অতিরিক্ত সময় লাগে এবং নম্বরের অযাচিত ব্যবধান তৈরি হয়, যার ফলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও লিখিত পরীক্ষা নিতে সাহস করছে না। আরেকদিকে, বহুনির্বাচনী প্রশ্নে পরীক্ষা নিতে যে পরিমাণ ফি নেয়া হয়, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।

ভর্তি পরীক্ষার কাজে যুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ লাখ টাকারও বেশি আয় করে থাকেন, আর অভিভাবকদের জন্য আলাদা আলাদা ফরম কেনা বা পরীক্ষার খরচ অনেক বেশি হয়ে দাঁড়ায়। দরিদ্র অভিভাবকদের জন্য এই খরচ এক ধরনের আতঙ্কের নাম। তবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা এই ধরনের অনেক সমস্যা কমাতে পারে, এবং দেশের মেডিকেল কলেজগুলো ইতিমধ্যেই এর সফল উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।

এমন পরিস্থিতিতে যদি একক ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে মতের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা না যায়, তবে বিকল্প ব্যবস্থা ভাবতে হবে। যেমন, এসএসসি পরীক্ষার ফল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য হয়ে থাকে, তেমনি এইচএসসি পরীক্ষার ফলও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচনা হতে পারে। যদি পাবলিক পরীক্ষার নম্বর নিয়ে কোনো দ্বিধা থাকে, তবে একেকটি খাতা দুইজন পরীক্ষক দ্বারা মূল্যায়ন করা যেতে পারে, এবং তাদের গড় নম্বরের ভিত্তিতে জিপিএ ও নম্বরপত্র তৈরি করা যেতে পারে।

মোটকথা, দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন থেকে বের হয়ে আসতে হবে, এবং এর জন্য কার্যকরী বিকল্প ব্যবস্থা প্রয়োজন।

লেখক: তারিক মনজুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *