শিক্ষক দিবসে এক অনমনীয় শিক্ষকের মৃত্যু ।

ডেক্স নিউজ, দেশীবার্তা,

শিক্ষক দিবসে এক অনমনীয় শিক্ষকের মৃত্যু
প্রায় ৩২ বছর ধরে যিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নির্মাণে, সেই শিক্ষক মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও একদিনের জন্য স্কুল থেকে বিরতি নেননি। দায়িত্ব ও ভালোবাসায় তিনি ছিলেন অটল। আর আজ, শিক্ষক দিবসের এই দিনে, সেই নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক চিরবিদায় নিলেন এই পৃথিবী থেকে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি আদর্শ শিক্ষক হিসেবে নিজের কর্তব্য পালন করে গেছেন।

পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার মুসুল্লীয়াবাদ একে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন জালাল উদ্দীন। দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে তিনি নিয়মিতভাবে বিদ্যালয়ে উপস্থিত থেকে শত শত শিক্ষার্থীর মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর অটল দায়িত্ববোধ ও নিষ্ঠার জন্য একাধিকবার পেয়েছেন সততা ও কর্মনিষ্ঠার স্বীকৃতি। শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় “জালাল স্যার” নামে পরিচিত। এই আদর্শবান ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বিশ্ব শিক্ষক দিবসের দিন, ৫ অক্টোবর, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, প্রায় দুই বছর আগে তাঁর শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ে। আজ রোববার (৫ অক্টোবর) দুপুর ৩টার দিকে নিজ বাড়িতেই তিনি পরলোকগমন করেন।

জালাল উদ্দীন স্যারের একমাত্র ছেলে সৈকত ইসলাম দেশীবার্তাকে জানান, দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে আজ দুপুর ৩টার দিকে নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সবার প্রিয় জালাল স্যার। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই সহকর্মী, প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে এই নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের স্মৃতি স্মরণ করে শোক প্রকাশ করছেন।

মুসুল্লীয়াবাদ এ কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, “জালাল স্যার ছিলেন আমাদের স্কুলের গর্ব। তাঁর শারীরিক অবস্থা যতই কঠিন হোক, কেউ ভাবতেও পারেনি তিনি একদিন বিছানায় পড়বেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ৩২ বছরের দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে গত ২০ বছরে তিনি কখনো সরকারি ছুটি (সিএল) নেননি। হাজিরা খাতায় নেই একদিনেরও অনুপস্থিতি। তিনি যা জানতেন, তা নিঃস্বার্থভাবে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। এমনকি ক্যান্সার ধরা পড়ার পরও আমাদের সহযোগিতা নিতে রাজি হননি। নিজের সীমিত সামর্থ্য নিয়েই ছিলেন সন্তুষ্ট। তাঁর মৃত্যুতে শিক্ষক দিবসেই উপকূলের শিক্ষাঙ্গণে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া।”

শিক্ষক জালাল উদ্দীনের একমাত্র ছেলে সৈকত ইসলাম দেশীবার্তা-কে বলেন, “আমি বাবার একমাত্র সন্তান। স্কুল থেকে আমি এসএসসি পাস করেছি, কিন্তু কখনো বাবার ছেলের বিশেষ কোনো সুবিধা পাইনি। পুরো স্কুলজীবন আমি বাবার একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে শিক্ষাগ্রহণ করেছি, সবার মতো।”

তিনি আরও বলেন, “আমার বাবা তার সরকারি পাওনা (সিএল) ছুটি কখনো নিতেন না। আমি বলতাম, ‘বাবা, ছুটি নিলে আমরা দাদা বাড়ি, নানা বাড়ি বেশি যেতে পারব।’ কিন্তু বাবা বলতেন, ‘আমি আমার চাকরি জীবনের একটিও দিন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সময় ব্যয় না করে থাকতে চাই না।’

বাবার শারীরিক অবস্থার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সৈকত বলেন, “দুবছর আগে বাবার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়েছিল, তখন এটি চতুর্থ ধাপে চলে গিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পরও অসুস্থ শরীর নিয়েই প্রতিদিন স্কুলে যেতেন।”

একজন সাবেক শিক্ষার্থী খেংশে রাখাইন দেশীবার্তালে জানান, “আমি স্যারকে সবসময় দেখতাম ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও স্কুলে আসতে। স্যার প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ছিলেন; বিদ্যালয়ের আঙিনায় বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগাতেন। যদিও তিনি ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন, ইংরেজির সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক শিক্ষাও দিতেন। আজ আমি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি, যা সম্পূর্ণ তাঁর ত্যাগ ও শিক্ষার ফল—এই কথায় কান্নায় ভেঙে পড়ি।”

উপজেলা শিক্ষা অফিসার মনিরুল ইসলাম বলেন, “আমি বহু বছর ধরে মুসুল্লীয়াবাদ এ কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক মো. জালাল উদ্দীন স্যারকে চিনি। তিনি একজন সত্যিকারের আদর্শ শিক্ষক। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবনে তাঁর অবদান অপ্রতিদ্বন্দ্বী।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *