ডেক্সরিপোর্ট, দেশীবার্তা।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, আইন শুধুমাত্র কিছু নিয়ম-কানুনের সমষ্টি নয়; এটি একটি জাতির নৈতিক চেতনা ও বিবেকের প্রতিফলন। তাঁর মতে, ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্রের ভিত্তি দৃঢ় হয়, আর ন্যায় পরাজিত হলে শক্তিশালী রাষ্ট্রও ধ্বংসের মুখে পড়ে।
শনিবার দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে আইন বিভাগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, মানবতার প্রতি অবিচার ও রাষ্ট্রীয় অমানবিকতার ভয়াবহ পরিণতি বিশ্ব দেখেছিল বলেই জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার জন্ম হয়েছিল। যখন কোনো রাষ্ট্র নাগরিকের মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় বা তাদের কণ্ঠরোধ করে, তখন ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো নৈতিক দায়িত্বে পরিণত হয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রসঙ্গ টেনে তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ছিল ন্যায়, সম্মান ও অস্তিত্বের অধিকারের সংগ্রাম। একইভাবে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির মর্যাদা, সমতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের লড়াই।
বিচার বিভাগ সংস্কার প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী নতুন বাস্তবতায় বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে প্রশাসনিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, নৈতিকভাবে দৃঢ় ও সাংবিধানিকভাবে শক্তিশালী একটি বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি বিচার বিভাগ সংস্কারের জন্য একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন, যার মূল লক্ষ্য হলো পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। তিনি জানান, গত ২৩ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে, যা গত পনেরো মাসের পরিকল্পিত প্রচেষ্টা ও যৌথ উদ্যোগের ফলাফল।
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, বিচার বিভাগের কাঠামোগত স্বাধীনতা দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখতে পারস্পরিক সহযোগিতা, আস্থা ও দূরদর্শিতা অপরিহার্য। তিনি জেলা আদালতের আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট বার, জেলা বিচারক এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এ রূপান্তর প্রক্রিয়ায় একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।
আইন শিক্ষার গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আইনের অধ্যয়ন কেবল একটি পেশাগত প্রশিক্ষণ নয়; এটি ন্যায় প্রতিষ্ঠার এক অবিচল সাধনা। প্রতিটি আইনজীবী ও বিচারককে মনে রাখতে হবে—প্রত্যেক আইনের পেছনে আছে একটি জীবন, আর প্রত্যেক রায়ের পেছনে আছে কারও ভাগ্য। ন্যায়ের সত্যিকারের মূল্য নিহিত আছে নিরপেক্ষ ও মানবিক বিচারের মধ্যে।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান স্মরণ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, “এই বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য মেধাবী আইনবিদ উপহার দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, এখান থেকে ভবিষ্যতেও এমন আলোকিত আইনজ্ঞ বের হবে, যারা জ্ঞান, নৈতিকতা ও মানবিকতায় উজ্জ্বল ভূমিকা রাখবে।”
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি এস. এম. এমদাদুল হক ও বিচারপতি এ. কে. এম. আসাদুজ্জামান। এছাড়াও অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, শিক্ষক, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।