জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনে ঢাকার প্রস্তাব: সম্মতি ও সংশয়ের দ্বন্দ্ব

জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনে ঢাকার প্রস্তাব: সম্মতি ও সংশয়ের দ্বন্দ্ব

ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের একটি কান্ট্রি অফিস স্থাপনের বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। তবে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দপ্তর জানিয়েছে, প্রস্তাবিত সমঝোতা স্মারকের (MoU) খসড়া নিয়ে তাদের সঙ্গে এখনও চূড়ান্ত আলোচনা হয়নি এবং অনুমোদিত নথিপত্রও তারা হাতে পায়নি।

গতকাল (রোববার) ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানান, ঢাকায় তিন বছরের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক একটি কার্যালয় স্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। এই খসড়া যাচাই শেষে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের কাছে পাঠানো হবে।

তবে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের (OHCHR) এক কর্মকর্তা জানান, ২৫ এপ্রিল সংস্থাটি সরকারের কাছে তাদের প্রস্তাবনা পাঠিয়েছিল। এরপর থেকে সরকারের পক্ষ থেকে আর কোনো আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ হয়নি এবং অনুমোদিত খসড়াটি এখনো তাদের হাতে পৌঁছেনি। ফলে, সমঝোতা স্বাক্ষরের বিষয়ে তারা এখনো কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।

বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করা ওএইচসিএইচআর সাধারণত দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা ও স্থায়ী মিশনের মাধ্যমে কার্যক্রম চালায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের জেনেভা মিশনের মাধ্যমে দরকষাকষির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বর্তমান প্রস্তাবে সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।

সরকারের অভ্যন্তরে মতবিরোধ

কার্যালয় স্থাপন নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। তাদের আশঙ্কা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উপস্থিতি দেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে। বিশেষ করে, পশ্চিমা দেশগুলো বিরোধী দল দমন এবং মানবাধিকার ইস্যুতে চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে এ কার্যালয়কে ব্যবহার করতে পারে।

এ বিষয়ে ৩ জুন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধি ও নিরাপত্তা সংস্থার কর্মকর্তারা প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অনেকেই জাতীয় কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেন, কেবলমাত্র আন্তর্জাতিক উপস্থিতি বাড়ানোর চেয়ে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

বর্তমানে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের কান্ট্রি অফিস রয়েছে ১৬টি দেশে—এর মধ্যে রয়েছে সুদান, সিরিয়া, ইয়েমেন, মেক্সিকো ও ফিলিস্তিনের মতো সংকটপূর্ণ অঞ্চল। উন্নত কোনো দেশে এখনো এই ধরনের অফিস স্থাপন করা হয়নি। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকেই এধরনের কার্যালয় স্থাপনের জন্য অগ্রাধিকার দেয় সংস্থাটি।

জাতিসংঘের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, বাংলাদেশসহ ৪৩টি দেশে এ ধরনের অফিস খোলার প্রস্তাব রয়েছে। ইতোমধ্যে পশ্চিমা কয়েকটি দেশ জাতিসংঘের এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে অর্থ সহায়তা দিয়েছে বলেও জানা গেছে।

প্রস্তাবের পেছনের প্রেক্ষাপট

২০২৩ সালের জুলাইয়ের গণআন্দোলনের পর সেই অক্টোবর মাসে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক ঢাকা সফর করেন। তিনি প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং বাংলাদেশে কার্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব দেন।

তবে এখনো দেশের ভেতরে বিভিন্ন পর্যায়ের মতপার্থক্য এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। জাতিসংঘও তাদের প্রস্তাবিত রীতিনীতির বাইরে গিয়ে কোনো সমঝোতা করবে না বলে ইঙ্গিত দিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *