ইরান যুদ্ধ করছে, রাশিয়া চুপ: মিত্রতা নাকি কৌশলগত দূরত্ব ?

ইরান যুদ্ধ করছে, রাশিয়া চুপ: মিত্রতা নাকি কৌশলগত দূরত্ব ?

মধ্যপ্রাচ্যে যখন ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের সংঘাত তীব্রতর হচ্ছে, তখন রাশিয়া—ইরানের প্রধান মিত্র—আচরণ করছে সম্পূর্ণ নীরবতার ভঙ্গিতে। একের পর এক আঘাত সইছে তেহরান, কিন্তু মস্কো সরাসরি কোনো সহায়তা দিচ্ছে না।

অল্প কিছুদিন আগেও ইরান ও রাশিয়ার সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ ও কৌশলগত। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ইরানের কাছ থেকে শাহেদ ড্রোন কিনেছিল, যা ইউক্রেনীয় লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে ব্যবহৃত হয়েছিল। সেই সময় ইরান রাশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ছিল।

২০২৩ সালের শেষ দিকে হামাসের ইসরায়েল আক্রমণের পর ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিশ্ব জনমত ব্যবহার করে রাশিয়া পশ্চিমের বিরোধিতা করে কূটনৈতিকভাবে সুবিধা নেয়। কিন্তু এরপর ইসরায়েল হিজবুল্লাহ ও হামাসের বিরুদ্ধে বড়সড় হামলা চালায় এবং ২০২৪ সালের এপ্রিল ও অক্টোবর মাসে ইরানের ওপরও পাল্টা হামলা করে।

এই আক্রমণে ইরানের সামরিক শক্তির সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পায়। ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, এমনকি রাশিয়ার তৈরি এস-৩০০ সিস্টেম পর্যন্ত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ অবস্থায় রাশিয়ার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল—হয় ইরানকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করবে, না হয় নিজেদের দূরে রাখবে। রাশিয়া দ্বিতীয়টিই বেছে নেয়।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ায় রুশপন্থী নেতা বাশার আল-আসাদকে সরিয়ে দেওয়া হয় বিদ্রোহীদের দ্বারা, তখনও রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেনি। এতে স্পষ্ট হয়, পুতিন এখন সরাসরি কোনো সংঘাতে জড়াতে চাইছেন না।

ইরান-রাশিয়ার মধ্যে এখনো কৌশলগত সহযোগিতা চলছে—যেমন স্যাটেলাইট উন্নয়ন ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধ প্রযুক্তি—but রাশিয়া প্রয়োজনীয় সামরিক সহায়তা (যেমন যুদ্ধবিমান বা উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা) দেয়নি, যা ইরানের পক্ষে ইসরায়েলের হামলা প্রতিহত করতে পারত।

রাশিয়ার এই নীরবতা নিছক কৌশলগত। পুতিন চান না এমন এক মিত্রের পাশে দাঁড়াতে, যে যুদ্ধক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। কারণ এতে নিজ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এছাড়া, রাশিয়ার জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কও গুরুত্বপূর্ণ। ওপেকের মাধ্যমে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণ, উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয়—এই কৌশলগত বাস্তবতায় ইরানকে সরাসরি সামরিক সহায়তা দেওয়া পুতিনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

রাশিয়া ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়েও বরাবরই দ্বিধায় ছিল। তারা যেমন চায় না ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হোক, তেমনি চায় না যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি করুক।

ইরান যদি কোণঠাসা হয়ে পড়ে, তাহলে হয়তো চুক্তি ভেঙে দিয়ে সরাসরি পারমাণবিক বোমার দিকে এগোতে পারে। তখন রাশিয়ার প্রভাব তেহরানের ওপর দুর্বল হয়ে পড়বে। এ সম্ভাবনাও রাশিয়ার জন্য উদ্বেগের।

এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার অবস্থান দ্বিমুখী। একদিকে পশ্চিমবিরোধী জোটে ইরানের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে চায়, অন্যদিকে ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের বাকি অংশের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়। ইউক্রেন যুদ্ধে সম্পূর্ণ ব্যস্ত পুতিন চাচ্ছেন না নতুন করে আরেকটি সংঘাতে জড়াতে।

ইরান চাইছে রাশিয়া অন্তত অংশীদার হিসেবে পাশে থাকুক, যাতে তাদের অবস্থান আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আরও শক্ত হয়। কিন্তু বাস্তবে রাশিয়ার প্রভাব সীমিত। যুদ্ধের ফলাফল কিংবা মার্কিন হস্তক্ষেপের ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রণ নেই।

পুতিন চাইছেন, ইরান ইস্যুতে নিজেকে ‘শান্তিপূর্ণ সমাধানদাতা’ হিসেবে তুলে ধরতে। কিছুদিন আগে তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান এবং ইরান নিয়ে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দেওয়ার ইঙ্গিত দেন।

সব মিলিয়ে বলা যায়, রাশিয়া হয়তো ইরানকে কৌশলগতভাবে সমর্থন করবে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মতো এসে পাশে দাঁড়াবে—এমনটা এখনই সম্ভব নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *