গাজি মো: নাজমুল ইসলাম

রাজনীতি মানেই কি কেবল ক্ষমতার লড়াই? ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, এর পরতে পরতে মিশে আছে একাকীত্ব, বিচ্ছেদ আর প্রিয় জন্মভূমি থেকে দূরে থাকার এক দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস। বিশেষ করে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে, যেখানে গণতন্ত্রের চাকা বারবার হোঁচট খায়, সেখানে রাজনৈতিক নির্বাসন এক নির্মম বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়।
যখন একটি দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন জেঁকে বসে, তখন ভিন্নমতের মানুষদের ওপর নেমে আসে দমন-পীড়নের খড়্গ। অনেক সময় নেতাকে বাধ্য করা হয় দেশ ছাড়তে। আবার কেউ কেউ অসীম সাহসে সব নিগ্রহ সহ্য করে দেশের মাটিতেই থেকে যান—যেমনটা আমরা দেখেছি বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে। বছরের পর বছর বঞ্চনা সয়েও তিনি মাটির মায়া ত্যাগ করেননি। অন্যদিকে, ইতিহাসের এক বিচিত্র সমীকরণে ২০২৪-এর জুলাই-পরবর্তী সময়ে আমরা দেখলাম এক সময়ের প্রতাপশালী শাসক শেখ হাসিনাকেও দেশান্তরী হতে হয়েছে। আসলে নির্বাসন যেমন রাজনীতির এক রূঢ় সত্য, ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ও তেমনি এক পলিমাটি মাখা আবেগের নাম।
দীর্ঘ প্রবাস বা নির্বাসন কাটিয়ে যখন কোনো জননেতা ফিরে আসেন, তখন সাধারণ মানুষের চোখে তিনি হয়ে ওঠেন আশার শেষ প্রদীপ। হাজারো মানুষ তাঁকে বরণ করে নিতে মেতে ওঠে মহোৎসবে। কিন্তু এই ফিরে আসাটা কি খুব সহজ? না, এই পথটি ফুলে বিছানো নয়, বরং কণ্টকাকীর্ণ। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর দেশের বদলে যাওয়া রাজনীতির সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানো, নিরাপত্তার ঝুঁকি আর মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশার চাপ—সব মিলিয়ে এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা।
বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে তাকালে ফিরে আসার একেকটি গল্প একেক রকম। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফিরে আসা ছিল এক নতুন রাষ্ট্রের পূর্ণতা পাওয়ার আনন্দ। যদিও সেটি প্রথাগত নির্বাসন ছিল না, কিন্তু সেদিন সাধারণ মানুষের চোখে যে আনন্দাশ্রু ছিল, তা ছিল এক পরম প্রাপ্তির। তবে ট্র্যাজেডি হলো, সেই স্বপ্নযাত্রার সমাপ্তি ঘটেছিল ৭৫-এর রক্তক্ষয়ীবিন্যাসে। যার ফলে শেখ হাসিনাকে দীর্ঘ সময় কাটাতে হয় বিদেশের মাটিতে। ৮১-তে তাঁর ফিরে আসা ছিল হারানো রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে পুনরুদ্ধারের এক লড়াই।
পরবর্তীতে আমরা দেখেছি সামরিক শাসনের অন্ধকার ফুঁড়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণতন্ত্রের নতুন সূর্যোদয়। কিন্তু টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়তে না পারায় দেশের গণতন্ত্র বারবার পথ হারিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আসে ১/১১-এর সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়। শারীরিক নির্যাতন আর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ২০০৮ সালে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তারেক রহমান। প্রবাসের সেই দিনগুলো তাঁর জন্য নিছক প্রবাস ছিল না, ছিল দেড় দশকের এক দীর্ঘ নির্বাসিত গঞ্জনা। নিজের প্রিয় মাটি, প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য থেকে দূরে থাকা যে কতটা কষ্টের, তা কেবল সেই মানুষটিই জানেন।
অবশেষে ২০২৪-এর জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই অভ্যুত্থান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সামনে খুলে দিয়েছে স্বদেশে ফেরার দ্বার। দীর্ঘ ১৭ বছরের এক দীর্ঘস্থায়ী নির্বাসন—যা শেখ মুজিব বা শেখ হাসিনার নির্বাসনকালের চেয়েও দীর্ঘতর।
আজ যখন তাঁর প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন ডানা মেলছে, তখন দেশ এক ক্রান্তিকাল পার করছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তম্ভ আজ ভঙ্গুর, সমাজ আজ নানা মতে বিভক্ত। চারদিকে এক অদ্ভুত শূন্যতা আর অস্থিরতা। এই বৈরী পরিবেশে তাঁর ফিরে আসা কেবল একজন নেতার ঘরে ফেরা নয়, বরং বহুত্ববাদী গণতন্ত্র আর সামাজিক সংহতি ফিরিয়ে আনার এক বড় চ্যালেঞ্জ।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এই স্বপ্ন কি পারবে বাংলাদেশের মানুষের বিভেদ মুছে দিয়ে এক নতুন ভোরের সূচনা করতে? দেশবাসী আজ সেই প্রত্যাশার চোখেই তাকিয়ে আছে।