রমজানে কী করা উচিত আর রমজানে কী করা উচিত নয়: একটি পরিপূর্ণ গাইড

রমজান মুসলিমদের জন্য একটি পবিত্র মাস, যা বিশেষভাবে রোজা রাখা, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করা, এবং আত্মবিশ্লেষণের জন্য একটি সময়। এটি আত্মিক উন্নতির, দান-খয়রাতের এবং তওবা-ইস্তিগফারের মাস। সারা পৃথিবীজুড়ে মুসলমানরা রোজা রেখে, নফসের নিয়ন্ত্রণ, আল্লাহর প্রতি ভক্তি, এবং সমাজের দরিদ্রদের সহায়তা করার জন্য চেষ্টা করেন। রমজান মাসে কীভাবে আমাদের জীবনকে আরও ভালো ও মঙ্গলময় করা যেতে পারে, সে বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ তুলে ধরা হলো।

Ramadan
রমজানে কী করা উচিত আর রমজানে কী করা উচিত নয়

১. রোজা রাখা

রমজান মাসে সেহরি থেকে ইফতার পর্যন্ত খাবার এবং পানীয় থেকে বিরত থাকা প্রধান কর্তব্য। এটি শুধুমাত্র শরীরের ক্ষুধা ও পিপাসা মেটানোর জন্য নয়, বরং আধ্যাত্মিক এবং মানসিক উন্নতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোজা রাখা মানুষের আত্মবিশ্বাস এবং ধৈর্য বাড়ায় এবং তাকে আল্লাহর প্রতি আরও কাছে নিয়ে যায়।

২. কোরআন তিলাওয়াত করা

রমজান হল কোরআন নাযিলের মাস। এই মাসে কোরআন পাঠের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রতিদিন কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে আমরা আমাদের আত্মিক জীবনে উন্নতি সাধন করতে পারি। যদি কোরআন পুরো মাসে একবার পড়া সম্ভব হয়, তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে ভালো। তিলাওয়াতের পাশাপাশি কোরআন অর্থসহ পড়ার চেষ্টা করা উচিত, যাতে বোঝা যায় আল্লাহ কী বার্তা দিয়েছেন।

৩. নফল নামাজ পড়া

রমজান মাসে ফরজ নামাজের পাশাপাশি আরও বেশি নফল নামাজ পড়ার সুযোগ থাকে। বিশেষ করে তারাবি নামাজ রমজান মাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নামাজ সারা মাসে মসজিদে জামাতে আদায় করা উচিত। এছাড়া, Tahajjud নামাজও রমজানে আদায় করা উচিত, যা রাতের শেষ ভাগে অনুষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে আমাদের অন্তর পরিশুদ্ধ হয় এবং আল্লাহর কাছে আরও বেশি নিকটবর্তী হতে পারি।

৪. তওবা ও ইস্তিগফার

রমজান হল ক্ষমা লাভের মাস। এই মাসে আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে, অর্থাৎ আমাদের পূর্বের ভুল, পাপ ও গোনাহের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। যারা মনে করেন যে তারা ভুলে গেছেন, তাদের জন্য রমজান একটি সুবর্ণ সুযোগ, যাতে তারা নিজেদের নতুন করে সংশোধন করতে পারেন। তওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত পাওয়া সম্ভব।

৫. দানে সহযোগিতা করা

রমজান মাসে বিশেষভাবে দান-খয়রাতের গুরুত্ব রয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, “যে ব্যক্তি মানুষের উপকারে আসে, আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন।” রমজান মাসে দরিদ্রদের সাহায্য করা, জাকাত প্রদান, বা অন্য যেকোনো ধরনের দান করা একটি মহৎ কাজ। রোজা রেখে আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর পাশাপাশি, আমাদের সমাজে দরিদ্রদের জন্য সহানুভূতির মানসিকতা তৈরি হয়।

৬. ঈদের প্রস্তুতি নেওয়া

রমজান মাসের শেষে ঈদ আসে, যা মুসলমানদের জন্য আনন্দের ও খুশির দিন। ঈদ উদযাপন শুধুমাত্র খাবার খাওয়ার বা পোশাক পরার ব্যাপার নয়, এটি একটি বিশেষ দিন যেখানে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মিলিত হওয়া, একে অপরকে ভালোবাসা এবং দান করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রমজান মাসে আমাদের উচিত আত্মবিশ্লেষণ করা এবং ঈদের আনন্দের মুহূর্তগুলো সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া।

৭. স্বাস্থ্য সচেতনতা

রোজা রাখার সময় আমাদের শরীরের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হয়। সেহরি ও ইফতারের খাবারে পুষ্টিকর খাবারের পরিমাণ ঠিক রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানি বেশি করে পান করতে হবে এবং হালকা ব্যায়াম করাও উচিত। খাবারের পুষ্টিগুণ ও পরিমাণের দিকে মনোযোগ দিলে আমাদের শরীর সুস্থ থাকে, যা রোজা রাখার সময় উপকারি।

রমজান একটি বিশেষ মাস, যা আমাদের আত্মবিশ্লেষণ, পরিশুদ্ধি এবং আল্লাহর প্রতি আমাদের সম্পর্ক গভীর করার জন্য সুযোগ প্রদান করে। এটি শুধু রোজা রাখার মাস নয়, বরং আত্মবিশ্বাস এবং মানবিক মূল্যবোধে উন্নতি সাধনের একটি সময়। আসুন, আমরা এই পবিত্র মাসে আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভের জন্য একযোগে প্রচেষ্টা চালাই এবং মানবতার কল্যাণে কাজ করি।

রমজানে কী করা উচিত নয়: কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা

রমজানে কী করা উচিত আর রমজানে কী করা উচিত নয়
রমজানে কী করা উচিত আর রমজানে কী করা উচিত নয়

রমজান মাস একটি পবিত্র সময়, যেখানে মুসলিমরা রোজা রাখে, কোরআন তিলাওয়াত করে, এবং আল্লাহর প্রতি নিজেদের সম্পর্ক আরও গভীর করে। তবে, রমজান শুধু ভালো কাজ করার মাসই নয়, বরং কিছু কাজ আছে যেগুলি এই মাসে পরিহার করা উচিত, যাতে আমাদের রোজা এবং অন্যান্য ইবাদত সম্পূর্ণরূপে গ্রহণযোগ্য হয়। নিচে রমজানে যেসব কাজ করা উচিত নয়, সে বিষয়ে কিছু নির্দেশনা তুলে ধরা হলো।

১. মিথ্যা বলা ও মিথ্যা কথার প্রচার করা

রমজান মাসে মিথ্যা বলা বা মিথ্যাচারের কোনো স্থান নেই। রোজা রাখার সময় মিথ্যা কথা বলা, কাউকে ধোঁকা দেওয়া বা গিবত (পরচর্চা) করা রোজার মূল উদ্দেশ্যকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমাদের উচিত রোজা রাখার সময় সত্য কথা বলা এবং অন্যদের সমালোচনা থেকে বিরত থাকা। কোরআনে বলা হয়েছে, “যারা রোজা রাখে, তারা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কাজ পরিহার করে।”

২. অতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়া করা

রমজান মাসে খাবার থেকে বিরত থাকা আমাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু অনেক সময়, ইফতার বা সেহরিতে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। রোজার শেষ সময়ে শরীরের অবস্থা খারাপ হতে পারে, যা আমাদের ইবাদতের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। সেহরি এবং ইফতার এমনভাবে করা উচিত যাতে শরীর ভালো থাকে, কিন্তু অতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়া না করা হয়। সাস্থ্যবান খাবারের দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

৩. অনর্থক সময় নষ্ট করা

রমজান হল আত্মিক উন্নতির মাস। তবে, অনেক সময় দেখা যায় যে মানুষ এই সময়টাকে বিনোদন বা অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করে, যেমন টেলিভিশন বা মোবাইলে অতিরিক্ত সময় কাটানো। এর পরিবর্তে, আমাদের উচিত বেশি সময় কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া, ইবাদত এবং সমাজসেবা কাজে ব্যয় করা। অনর্থক কাজের মধ্যে সময় নষ্ট করলে রমজানের প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না।

৪. নফসের অনুসরণ করা (অশালীনতা ও পাপ কাজে লিপ্ত হওয়া)

রমজান মাসে রোজার জন্য শুধু খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকা নয়, বরং সকল ধরণের পাপ ও অশালীন কাজ থেকে বিরত থাকা জরুরি। রোজা থাকা অবস্থায় অশালীন দৃষ্টিভঙ্গি বা কথাবার্তা বলা, মন্দ কাজের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাওয়া, বা নফস (ইচ্ছা) এর অনুসরণ করা রোজার উদ্দেশ্যকে অকার্যকর করতে পারে। এটি আমাদের আত্মিক উন্নতিতে বাধা দেয়।

৫. কোনো ধরনের গিবত বা কুৎসা রটানো

রোজা রাখার সময়ে গিবত (অন্যের পেছনে বাজে কথা বলা) বা কুৎসা রটানো একেবারেই পরিহার করা উচিত। ইসলামে গিবতকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি রোজার মধ্যে যদি গিবত করা হয়, তবে তা রোজার মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে। রোজা রাখা এক ধরনের আত্মবিশ্লেষণ, এবং আমাদের উচিত মানুষের সম্মান রক্ষা করা ও তাদের প্রতি সদয় থাকা।

৬. অতিরিক্ত ঘুমানো

রমজান মাসে অতিরিক্ত ঘুমানোর প্রবণতা তৈরি হতে পারে, বিশেষ করে সেহরি বা ইফতারের পর। তবে, এটি রোজার উদ্দেশ্য এবং দৈনন্দিন জীবনের জন্য অস্বাস্থ্যকর হতে পারে। বিশেষ করে দিনের বেলা ঘুমিয়ে থাকা রোজার ইবাদতকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই সময়টাতে আমাদের উচিত বেশি পরিমাণে ইবাদত, কোরআন পাঠ, এবং দান-খয়রাতের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখা।

৭. গোসল বা শারীরিক চাহিদা পূরণ করা

রমজান মাসে রোজা রাখা অবস্থায় সঙ্গম বা শারীরিক চাহিদা পূরণ করা হারাম। এমন কিছু করতে গিয়ে রোজার গুরুত্ব এবং উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে। রোজা রাখতে গেলে, বিশেষভাবে সেহরি ও ইফতারের সময় শরীরের প্রতি যত্ন নিতে হয় এবং শারীরিক চাহিদা বা বাসনা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

রমজান একটি অত্যন্ত পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ মাস, যেখানে আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিকের পরিশুদ্ধি ঘটাতে হবে। আমরা যদি রমজান মাসে অপ্রয়োজনীয় কাজগুলো পরিহার করি এবং ইবাদত ও ভালো কাজের দিকে মনোযোগী হই, তবে আল্লাহ আমাদেরকে আরও বেশি রহমত এবং ক্ষমা প্রদান করবেন। এই মাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে আমাদের উচিত খারাপ অভ্যাসগুলো পরিহার করা এবং ভালো কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা।

ইসলামিক ডেস্ক – দেশী বার্তা নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *