২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে দেশজুড়ে চলা রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে ১৬৮ জন পথশিশু প্রাণ হারিয়েছে, যা ওই সময়ের মোট মৃত্যুর প্রায় ১২ শতাংশ। যদিও জাতীয়ভাবে তালিকাভুক্ত ১৩,৫২৯ জন আহতদের মধ্যে শিশুদের সুনির্দিষ্ট তথ্য সেভাবে পাওয়া যায়নি।
শনিবার ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে আসে। অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল “একমাত্রা সোসাইটি” এবং “লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লিডো)”। গবেষণাটি অর্থায়ন করেছে গ্লোবাল ফান্ড ফর চিলড্রেন।
সংঘর্ষে গুলির কারণে চোখে গুরুতর আঘাত নিয়ে ৫০৬ জনকে চিকিৎসা দিতে হয়। এর মধ্যে ৬০ জন শিশু ছিল, যাদের একজন মাত্র ৯ বছর বয়সে চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারায়।
কর্মকর্তারা জানান, শুধুমাত্র কারওয়ান বাজার এলাকা থেকেই ৪৩ জন পথশিশুকে কোনো ধরনের আইনগত সহায়তা ছাড়া আটক করা হয়েছিল এবং তাদের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
ব্র্যাকের তথ্যমতে, অস্থিরতার সময় ঢাকার ৬২ শতাংশ পথশিশু তাদের থাকা জায়গা হারায়। ইউনিসেফ জানায়, সীমান্ত এলাকায় অভিভাবকহীন শিশুর সংখ্যা এক লাফে ২০০ শতাংশ বেড়ে যায়। আর এইচআরডাব্লিউ স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, পুলিশের অভিযানের পর অনেক শিশু আশ্রয়স্থল ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।
এই গবেষণায় ৭০ জন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর কেস স্টাডি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যেসব এলাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে গিয়ে সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে উঠে আসে, সহিংসতার মধ্যে ৭২ শতাংশ শিশু সরাসরি আক্রান্ত হয়, কেউ আঘাতপ্রাপ্ত, কেউ ভয়ংকর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে। প্রায় অর্ধেক শিশু আহত হয়েছে, যার মধ্যে অনেকের মাথায় আঘাত ও ছররা গুলির ক্ষত রয়েছে। ১৩ শতাংশ শিশুকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার তথ্যও উঠে এসেছে।
শিশুদের মধ্যে সহিংসতা সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা ছিল না ৪১ শতাংশের। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর তারা কেবল বুঝতে পেরেছে কী ঘটছে। তবে ৩৬ শতাংশ শিশু আন্দোলনের উদ্দেশ্য জানত। আবার ৫৫.৭ শতাংশ শিশু সরাসরি সহিংসতায় অংশ নেয়। ব্যক্তিগত বিশ্বাস, রাজনৈতিক দলের প্রভাব এবং নিরাপত্তা-ঝুঁকি এসব সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে।
আন্দোলনের সময় ৫৪ শতাংশ শিশু খাদ্য, পানি ও আশ্রয়ের অভাবে কষ্ট পায়। ৬০ শতাংশ শিশুর উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। অনেকে কমিউনিটি বা পরিচিতদের সহায়তায় কোনোমতে টিকে ছিল।
তবে মানসিকভাবে বড় ক্ষতি হয়ে যায়। ৬১ শতাংশ শিশু বলেছে, তারা ভয়, আতঙ্ক ও মানসিক আঘাতে ভুগছে। অর্ধেকের বেশি শিশু দুঃস্বপ্ন দেখে বা হতাশাগ্রস্ত হয়েছে। ৭৫ শতাংশের বেশি এখনও বিষণ্নতায় ভুগছে।
লিডোর গবেষণার তথ্যমতে, সহিংসতা শেষ হলেও ৬১ শতাংশ শিশু বর্তমানে তাদের পরিবেশ কিছুটা নিরাপদ মনে করে। যদিও মানসিক ক্ষত কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৪১ শতাংশ শিশু এনজিও ও কমিউনিটির সহায়তা পেয়েছে, ৩৪ শতাংশ পরিচিতদের ওপর নির্ভর করেছে। মাত্র ১৯ শতাংশ শিশু পরিবারে যোগাযোগ রাখতে পেরেছে।
বর্তমানে ৩৩ শতাংশ শিশু ভিক্ষা করে, ২৩ শতাংশ বোতল কুড়িয়ে জীবন চালায় এবং অনেকেই রেলস্টেশন বা রাস্তার পাশে ঘুমায়। যদিও ৪০ শতাংশ শিশু নিজেদের শারীরিকভাবে সুস্থ বলে জানায়, তাদের জীবন এখনো চরম ঝুঁকিপূর্ণ।
গবেষণা উপস্থাপন করেন একমাত্রা সোসাইটির পরিচালক ও গবেষক ড. নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস। তিনি বলেন, গত তিন দশকে রাজনৈতিক সহিংসতার সময় বারবার পথশিশুরা ব্যবহার ও ক্ষতির শিকার হয়েছে। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেও তারা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে, এবং এই সহিংসতা তাদের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে।
তিনি আরও বলেন, পথশিশুরা রাস্তাকে কেন্দ্র করেই জীবিকা ও বাসস্থান গড়ে তোলে। রাজপথে সংঘটিত সহিংসতা তাদের জীবনধারাকে করে দেয় আরও সংকটময়। এই বাস্তবতায় সরকার, রাজনীতিক, চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীদের এই শিশুদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।