বর্তমান সরকার আমলে বিভিন্ন ভাতা কর্মসূচির অর্থ বিতরণে ব্যবহৃত মোবাইল আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’ সম্পর্কে গুরুতর অনিয়মের তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ফরেনসিক অডিটে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি সরকারপ্রদত্ত প্রায় ১,৭১১ কোটি টাকা বিতরণে অননুমোদিত ডিস্ট্রিবিউটর ব্যবহার করে সেই অর্থ আত্মসাৎ করেছে। এছাড়াও ই-কমার্স লেনদেনের নামে ভোক্তাদের কাছ থেকে আরও ১৪৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, নগদ কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন না নিয়েই অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি তৈরি করে, যা দেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ৫০০ কোটি টাকার মানিলন্ডারিংয়ের প্রমাণও পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে তদন্তে আড়াই হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে।
নগদের সাবেক এমডি তানভীর এ মিশুক এবং তার ঘনিষ্ঠ একটি সিন্ডিকেট এসব অর্থ লেনদেনে জড়িত বলে ফরেনসিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। উল্লেখ্য, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেনে জড়িত গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট হঠাৎ বন্ধ করে তাদের টাকাও প্রতিষ্ঠানটি আত্মসাৎ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, নগদ এবং কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে আকর্ষণীয় অফারের মাধ্যমে গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করেছে। এসব প্রতারণামূলক লেনদেনের সময় সরকার ই-কমার্স নীতিমালা সংশোধন করলে প্রতিষ্ঠানগুলো চাপে পড়ে, এবং গ্রাহকের অর্থ ফেরত দেওয়ার ঘোষণা দিয়েই পরে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে দেখা যায়, নগদ অনুমোদন ছাড়াই নিজস্ব একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করে, যেটি প্রকৃত লেনদেনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন ছিল। এই মিথ্যা রিপোর্ট পোর্টালের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডাক বিভাগকে ভুল তথ্য সরবরাহ করত।
২০১৮ সালের নীতিমালায় বলা হয়েছিল, শুধুমাত্র তফসিলি ব্যাংকসমূহ এমএফএস পরিচালনা করতে পারবে। কিন্তু ২০১৯ সালে ডাক বিভাগ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই নগদ চালু করে। ২০২০ সালে ছয় মাসের জন্য প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হলেও সেটি এখন পর্যন্ত ৯ বার বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বহাল রাখা হয়েছে। অথচ আজও নগদ কোনো আইনি কাঠামোর আওতায় আসেনি।
এদিকে, নগদ পরিচালনায় নিয়োজিত ‘নগদ লিমিটেড’ নামক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বৈধ চুক্তিও নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। কেবল ২০১৭ সালের পোস্টাল ক্যাশ কার্ড সংক্রান্ত একটি পুরোনো চুক্তি ছাড়া নতুন কোনো চুক্তিপত্র দেখাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষার্থে আমরা প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছিলাম, তবে আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় আপাতত পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। আদালতের চূড়ান্ত নির্দেশনা পাওয়ার পরই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বর্তমানে দেশের মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস খাতে নগদের শেয়ার ১৮.৬৪ শতাংশ, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রায় ৯ কোটির বেশি গ্রাহক নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি দৈনিক ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেন সম্পন্ন করে।