ডেক্স রিপোর্ট, দেশী বার্তা।

কক্সবাজার বিমানবন্দর পেল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল রোববার বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিএ-১ শাখার যুগ্ম সচিব আহমেদ জামিল স্বাক্ষরিত এক সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর এবার কক্সবাজারও দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তালিকায় যুক্ত হলো।
বিমানবন্দরটি বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে নির্মিত। এর রানওয়ের মোট দৈর্ঘ্য ১০ হাজার ৭০০ ফুট, যার মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৭০০ ফুট অংশ সাগরের ভেতরে সম্প্রসারিত।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাওয়ার পর এখন এখান থেকে বিদেশগামী ফ্লাইট পরিচালনায় কোনো প্রশাসনিক বাধা নেই। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও এগিয়ে চলছে।
বেবিচকের তথ্যমতে, বিমানবন্দরে ঝিনুকের নকশায় নির্মিত নতুন টার্মিনাল ভবনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভবনটির আয়তন প্রায় ১০ হাজার ৯১২ বর্গফুট, যা দেশের অন্যতম আধুনিক টার্মিনাল হিসেবে গড়ে উঠছে।
এ ঘোষণায় স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের প্রত্যাশা, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু হলে বিদেশি পর্যটকের আগমন বাড়বে, যা কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করবে। তবে বিমান চলাচল খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রকৃত সুফল পেতে প্রয়োজন অবকাঠামো উন্নয়ন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর প্রস্তুতিতে কক্সবাজার বিমানবন্দর
কক্সবাজার বিমানবন্দরের পরিচালক গোলাম মুর্তজা হোসেন জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি দ্রুত এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের সব প্রয়োজনীয় সুবিধা স্থাপন করা হয়েছে। কিছু আনুষঙ্গিক কাজ এখনও সম্পন্ন হয়নি, তবে চূড়ান্ত অনুমোদন মিললেই চলতি মাসের মধ্যেই আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
গত ১৪ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিমানবন্দরের নির্মাণকাজের অগ্রগতি দেখতে কক্সবাজার সফর করেন। এ সময় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আমিনুল হাসিব তাঁকে নির্মাণকাজের সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করেন। জানানো হয়, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি চালু হলে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০টি ফ্লাইট এখানে অবতরণ ও উড্ডয়ন করতে পারবে। সে সময় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, নির্মাণকাজের প্রায় ৯৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে এবং অবশিষ্ট কাজ ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
২০১৭ সালে মিয়ানমারে সেনা অভিযানের কারণে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। এর পর থেকেই স্থানীয় এলাকায় বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি এনজিও সংস্থার কার্যক্রম বেড়ে যায়। বর্তমানে এসব সংস্থায় বিপুলসংখ্যক বিদেশি কর্মী কাজ করছেন। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু হলে তাঁদের সরাসরি কক্সবাজারে আসা সহজ হবে, যা স্থানীয় অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সাগরপাড়ের মানুষের আনন্দ
কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাওয়ায় জেলার মানুষ উচ্ছ্বসিত। কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী জানান, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হলে বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা বাড়বে। এতে হোটেল–মোটেল, রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য পর্যটন–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে বলে তিনি আশা করেন।
কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হলে পর্যটন শিল্পে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। এতে আন্তর্জাতিক সম্মেলন, করপোরেট অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক আয়োজন কক্সবাজারেই আয়োজন করা সহজ হবে, যা স্থানীয় কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
৬ হাজার কোটি টাকার তিনটি প্রকল্প
কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে রূপ দিতে সরকার তিনটি বড় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার মোট ব্যয় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। এই প্রকল্পগুলোর কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী—
- কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ১৫ কোটি টাকা।
- রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পে খরচ হচ্ছে প্রায় ৩ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা।
- আর আন্তর্জাতিক যাত্রী টার্মিনাল ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় নির্ধারিত হয়েছে ২৭৭ কোটি টাকা।
প্রথম প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০০৯ সালে, যা এখনো চলমান। পরবর্তী দুটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় যথাক্রমে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে।
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হওয়ার শর্ত
একটি বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করতে কিছু নির্দিষ্ট মানদণ্ড পূরণ করতে হয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম জানান, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হওয়ার প্রধান শর্ত হলো পর্যাপ্ত যাত্রীসংখ্যা। অর্থাৎ বিদেশে যাওয়া–আসার মতো যাত্রী না থাকলে বিমানবন্দর টেকসইভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য আধুনিক অবকাঠামো, নিরাপত্তা ও সেবা–সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। বিমানগুলোর জন্য রিফুয়েলিং ব্যবস্থা, হ্যাঙ্গার ও রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধা থাকতে হবে। পাশাপাশি বিদেশি এয়ারলাইনগুলোর জন্য এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে তারা নির্বিঘ্নে ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারে।

কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল ভবন।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছাতে যা প্রয়োজন
একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলোর একটি হলো কার্গো সুবিধা। শুধু যাত্রী পরিবহন নয়, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর মাধ্যমে নিয়মিত পণ্যও আসে–যায়। এ কারণে নিরাপদ কার্গো ব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত ওয়্যারহাউস এবং কার্যকর নিরাপত্তা অবকাঠামো থাকা অপরিহার্য। একইভাবে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের অন্যতম অংশ। এসব শর্ত পূরণ করতে পারলে কক্সবাজার বিমানবন্দর সত্যিকারের অর্থে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে কার্যকর হতে পারবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম জানান, কক্সবাজার বিমানবন্দরে সমুদ্রের ওপর নতুন ও দীর্ঘ রানওয়ে নির্মাণ একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এটি যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি বৃহৎ আকারের বিমান অবতরণেরও সুযোগ তৈরি করবে।
বিদেশি যাত্রীর অভাব ও সম্ভাবনার প্রশ্ন
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে টেকসইভাবে পরিচালিত হতে হলে পর্যাপ্ত যাত্রী থাকা অপরিহার্য। কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, “কক্সবাজারে কারা বিদেশ থেকে আসবেন বা এখান থেকে কোথায় যাবেন—এই প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট নয়।”
সরকার আশা করছে, বিদেশি পর্যটকেরা কক্সবাজারে আসবেন, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এখনো শহরটি বিদেশি পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত আকর্ষণীয় নয়। সৈকত এলাকায় আধুনিক বিনোদন সুবিধা, নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো এখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে বিদেশি পর্যটকেরা মূলত সুন্দরবন, সিলেট বা চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভ্রমণেই বেশি আগ্রহী। এই বাস্তবতায় কক্সবাজারে বিদেশি যাত্রীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে না–ও বাড়তে পারে।
পর্যটন আয় কমেছে
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ বিদেশি পর্যটন থেকে আয় করেছিল প্রায় ৪৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার, কিন্তু ২০২৪ সালে তা নেমে এসেছে ৪৪ কোটি ডলারে। অর্থাৎ এক বছরে আয় কমেছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫৯ কোটি টাকার সমান (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসেবে)।
অবকাঠামো ও কার্গো সুবিধায় ঘাটতি
কাজী ওয়াহিদুল আলমের মতে, দেশি বিমান সংস্থাগুলোর অনেকেই এখনো কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনায় আগ্রহী নয়। আর বিদেশি এয়ারলাইনগুলো এখানে ফ্লাইট চালাতে আগ্রহ দেখাবে কিনা, সেটিও এখনো যাচাই করা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, সমুদ্রের ওপর দৃষ্টিনন্দন রানওয়ে নির্মিত হলেও পুরো কাজ এখনো শেষ হয়নি। টার্মিনাল ভবনের কিছু অংশের কাজ বাকি আছে, নিরাপত্তা অবকাঠামোও পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। পাশাপাশি পর্যাপ্ত জনবল ও কার্গো সুবিধারও ঘাটতি রয়েছে। তাই কেবল ঘোষণার মধ্যেই কক্সবাজার বিমানবন্দরকে কার্যকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে ধরা যায় না—এর জন্য এখনো অনেক প্রস্তুতি নেওয়া বাকি।