বইয়ের মান নিয়ে কোনো আপস নয়: বাতিল হলো ৭০০ টন কাগজ

বইয়ের মান নিয়ে কোনো আপস নয়: বাতিল হলো ৭০০ টন কাগজ

২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য শিক্ষার্থীদের হাতে মানসম্পন্ন নতুন পাঠ্যবই তুলে দিতে শুরু থেকেই ‘শূন্য সহনশীল’ নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। নিম্নমানের বই ছাপানোর সব ধরনের কৌশল রুখতে এবার নেওয়া হয়েছে ‘কচ্ছপের কামড়’ বা নাছোড়বান্দা নীতি। এর অংশ হিসেবে, মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১২টি কঠোর শর্ত মেনে চলতে বাধ্য করা হয়েছে, যার একটিও পূরণ না হলে তাদের কার্যাদেশ বাতিল করা হবে।

নতুন নিয়মের ফলে ইতিবাচক ফলও মিলতে শুরু করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) যৌথভাবে বই ছাপার কাজ শুরুর আগেই প্রায় ৭০০ টন নিম্নমানের কাগজ বাতিল করেছে। এর মধ্যে, ছাপাখানায় আসার পর আরও ১০০ টন কাগজ বাতিল করা হয়। বিশেষ করে শিশুদের চোখের সুরক্ষায় ‘অপটিক্যাল ব্রাইটনিং এজেন্ট (ওবিএ)’ মুক্ত কাগজ ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কাগজের স্থায়িত্ব এবং পুরুত্বও (জিএসএম) বাড়ানো হয়েছে। এই কঠোর মানদণ্ড নিশ্চিত করতে এনসিটিবি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা মাঠে নেমেছেন।

নতুন শিক্ষাক্রমে বই নিয়ে বিগত বছরগুলোর বিতর্ক এড়াতে সরকার বদ্ধপরিকর। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরারের স্পষ্ট নির্দেশনার পর এনসিটিবি নড়েচড়ে বসেছে। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি বই ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। ৬১টি প্রেস এই কাজটি করছে। মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে প্রতিটি প্রেসে একজন পরিদর্শন এজেন্সির প্রতিনিধি সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকছেন। এর ফলে, ছাপা শুরুর আগেই বিভিন্ন ছাপাখানার ৬০০ টনের বেশি কাগজ বাতিল করা হয়েছে, কারণ সেগুলো শর্ত পূরণ করতে পারেনি। এমনকি, প্রাথমিক ছাড়পত্রের পরও দুটি ছাপাখানার প্রায় ১০০ টন কাগজ বাতিল করা হয়েছে।

চিকিৎসকদের পরামর্শে এবারই প্রথম শিশুদের চোখের সুরক্ষার জন্য ওবিএ-মুক্ত কাগজ ব্যবহারের শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। এই ধরনের অফ-হোয়াইট বা প্রাকৃতিক রঙের কাগজ তৈরিতে শতভাগ ‘ভার্জিন পাল্প’ ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কাগজের স্থায়িত্ব (বাস্টিং ফ্যাক্টর) ১৬ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ এবং পুরুত্ব (জিএসএম) ৮২ থেকে ৮৫ গ্রাম করা হয়েছে। কাগজের ‘অপাসিটি’ অর্থাৎ, এক পৃষ্ঠার লেখা যাতে অন্য পৃষ্ঠায় দেখা না যায়, সেই বিষয়টির ওপরেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

শুরুতে কাগজের নতুন ও কঠোর শর্ত নিয়ে প্রেস মালিক এবং পেপার মিলগুলো কিছুটা দ্বিধায় পড়েছিল। বিশেষ করে, অপাসিটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। এনসিটিবি ৮০ জিএসএম কাগজে ৯০ শতাংশ এবং ৭০ জিএসএমে ৮৫ শতাংশ অপাসিটি নির্ধারণ করলেও পেপার মিলগুলো জানায়, তাদের পক্ষে সর্বোচ্চ ৮৫ ও ৮০ শতাংশ অপাসিটি দেওয়া সম্ভব। এ নিয়ে বেশ কয়েকদিন কাজ আটকে থাকার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পেপার মিল এবং প্রেস মালিকদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে অপাসিটির পরিমাণ কমানো হয়। বর্তমানে ৮০ জিএসএম কাগজে ৮৫ শতাংশ এবং ৭০ জিএসএমে ৮২ শতাংশ অপাসিটির মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে।

নিম্নমানের বই ছাপানো ঠেকাতে এনসিটিবি এবার বেশ কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। প্রথমবারের মতো, প্রতিটি ফর্মার (বইয়ের একটি অংশ) ওপর সংশ্লিষ্ট প্রেসের নাম ছাপানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে বইয়ের কোনো সমস্যা হলে সহজেই দায়ী প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা যাবে। এছাড়া, কাগজ পরীক্ষার জন্য দ্বৈত ল্যাবের ব্যবস্থা এবং প্রতিটি প্রেসে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি করা হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এনসিটিবিতে একটি ল্যাব স্থাপন করা হচ্ছে, যেখানে কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কাগজের মান পরীক্ষা করা হবে। এর ফলে, কোনো প্রেস মালিক পরিদর্শন এজেন্সিকে প্রভাবিত করতে পারবেন না।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য মোট ৩০ কোটিরও বেশি বই ছাপার দরপত্র দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। তবে, নানা অনিয়মের অভিযোগে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ১১ কোটি ৮৯ লাখ বই ছাপানোর প্রস্তাব সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ আটকে দিয়েছে। নবম শ্রেণির বইয়ের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া এখনও চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *