বিলাসী জীবন পেছনে ফেলে সাধারণ মানুষের নেতা হয়ে উঠেছেন—কে এই নোবেলজয়ী মাচাদো?

রয়টার্স ওদ্য গার্ডিয়ান

বিলাসী জীবন পেছনে ফেলে সাধারণ মানুষের নেতা হয়ে উঠেছেন—কে এই নোবেলজয়ী মাচাদো?
ভেনেজুয়েলার বিরোধী নেতা মারিয়া কোরিনা মাচাদো

ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেতা মারিয়া কোরিনা মাচাদো আজ শুক্রবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নরওয়ের নোবেল কমিটি জানিয়েছে, ভেনেজুয়েলায় গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় এবং দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য এই সম্মান প্রদান করা হয়েছে।

নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, মাচাদো এক বছর ধরে আত্মগোপনে ছিলেন। জীবন কঠিন হুমকির মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজ দেশে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন, যা লাখ লাখ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি দেশের বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং সামরিকীকরণের বিরুদ্ধে সব সময় সতর্ক ছিলেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন।

নোবেল কমিটির সচিব ক্রিশ্চিয়ান বার্গ হার্পভিকেনকে ফোনে ৫৮ বছর বয়সী মাচাদো বলেন, “ওহ ঈশ্বর… আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমি আপনাদের অনেক ধন্যবাদ জানাই। আশা করি, সবাই বুঝবেন এটি কেবল আমার নয়, এটি একটি সামাজিক আন্দোলনের অর্জন। আমি শুধু একজন মানুষ, আমি একা এটির যোগ্য নই।”

উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্ম

মারিয়া কোরিনা মাচাদো ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ভেনেজুয়েলার ইস্পাতশিল্পে একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন।

শিক্ষাজীবনে মারিয়া কারাকাসের আন্দ্রেস বেলো ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি এবং একই শহরের ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইইএসএ) থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৯২ সালে তিনি অ্যাথেনিয়া ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন, যা কারাকাসের পথশিশুদের কল্যাণে কাজ করে। উচ্চবিত্ত পরিবারের পটভূমি থাকায় তিনি শাসক সমাজতান্ত্রিক দলের লক্ষ্যবস্তুতে সহজেই পরিণত হন।

রাজনৈতিক জীবন

বার্তা সংস্থা এপি জানায়, রাজনীতিতে প্রবেশের আগে মারিয়া কোরিনা মাচাদো ‘সুমাতে’ নামের একটি ভোট পর্যবেক্ষণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২০১০ সালে তিনি বিরোধীদলীয় জোট থেকে ভেনেজুয়েলার জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

২০১২ সালে মারিয়া ‘ভেন্তে ভেনেজুয়েলা’ নামের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৪ সালে তিনি নিকোলা মাদুরোর সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হন।

মাচাদো ভেনেজুয়েলায় উদার অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রবক্তা। তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি পিডিভিএসএ সহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণের পক্ষপাতী। পাশাপাশি দেশের সবচেয়ে দরিদ্র নাগরিকদের কল্যাণমূলক কর্মসূচি চালানোরও তিনি প্রবল সমর্থক।

সংঘবদ্ধ সংগ্রাম

মাচাদো কখনো কখনো আত্মকেন্দ্রিক বা অহংকারী হিসেবে সমালোচিত হয়েছেন। এমনকি তাঁর মা-ও এই বৈশিষ্ট্যের সমালোচনা করেছেন। তবুও তিনি প্রকাশ্যে নিজের সম্পর্কে খুব কমই কথা বলেন।

মারিয়া নিজের কর্মজীবনকে ‘মুক্তি ও ঐক্যের’ সামগ্রিক সংগ্রাম হিসেবে দেখেন। ভেনেজুয়েলায় অর্থনৈতিক সংকট ও সামাজিক অবক্ষয়ের মুখে থাকা মানুষের মধ্যে আশা জাগিয়ে রাখা তিনি নিজের প্রধান দায়িত্ব মনে করেন।

আত্মগোপন

২০২৩ সালে মাচাদো ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় প্রার্থী হিসেবে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাথমিক বাছাইয়ে মনোনীত হন। কিন্তু তাঁকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এই পরিস্থিতিতে তাঁর সহযোগী অ্যাডমান্ডো গঞ্জালেস বিরোধীদলীয় প্রার্থী হন, এবং মাচাদো তাঁকে সমর্থন দিয়ে প্রচারে অংশ নেন।

গত বছরের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনে ভেনেজুয়েলার নির্বাচন কর্তৃপক্ষ ও সর্বোচ্চ আদালত প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোকে তৃতীয়বারের মতো জয়ী ঘোষণা করেন। বিরোধীরা ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ শুরু করেন, যা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রেসিডেন্ট মাদুরো বিক্ষোভ কঠোর হাতে দমন করেন। এতে বেশ কয়েকজন নিহত হন এবং বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। এই নিপীড়নের মধ্যে অ্যাডমান্ডো গঞ্জালেস কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর দেশ ছাড়েন। কিন্তু মাচাদো ঝুঁকি নিয়ে এখনও দেশে আত্মগোপনে রয়েছেন।

ব্যক্তিগত জীবন

মাচাদো তিন সন্তানের মা। নিরাপত্তার কারণে তাঁর সন্তানরা বিদেশে বসবাস করেন। তিনি বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চেক প্রজাতন্ত্রের ‘ভাচলাভ হাভেল হিউম্যান রাইটস প্রাইজ’ এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ‘সাখারভ প্রাইজ’, যা মানবাধিকার রক্ষা এবং স্বাধীন চিন্তাধারার জন্য প্রদান করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *