শিশুদের অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ কি খারাপ? কারণ ও সমাধান কী?

শিশুদের অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ কি খারাপ? কারণ ও সমাধান কী?
সাধারণত বয়স দুই বছর হওয়ার পরও লালা পড়াটা অস্বাভাবিক হতে পারেছবি: পেক্সেলস

লালা, থুতু বা স্যালাইভা মুখের ভেতর নিঃসৃত অতিজরুরি তরল যা মুখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি খাবার হজমে সহায়তা করে, দাঁতের পচন প্রতিরোধ করে এবং মুখের ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। তবে কিছু শিশুদের ক্ষেত্রে লালা নিঃসরণের মাত্রা বেশি হতে পারে। এটি সাধারণত একেবারে ছোট বয়সের শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে বয়স দুই বছর হওয়ার পরও লালা পড়া একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার হতে পারে।

যদি শিশুর কথা বলার সময়, ঘুমের মধ্যে বা এমনিতেই অতিরিক্ত লালা গড়িয়ে পড়ে, তবে এটি একটি চিন্তার বিষয় হতে পারে। অতিরিক্ত লালা পড়া বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন দাঁতের মাড়ি বা স্নায়ুতন্ত্রের কোনো সমস্যা, অথবা শিশুর মুখের পেশী ও স্নায়ুতন্ত্রের দুর্বলতা। যদি এই সমস্যা দীর্ঘ সময় ধরে থাকে বা শিশুর অন্য কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

শিশুদের অতিরিক্ত লালা নিঃসরণের বেশ কিছু সম্ভাব্য কারণ রয়েছে, যার মধ্যে কিছু শারীরিক এবং কিছু পরিবেশগত কারণে হতে পারে:

  1. দাঁত ওঠা: সাধারণত ছয় মাস বয়সের পর শিশুদের দাঁত ওঠা শুরু হয়। এই সময়ে তারা শূলশূল বা অস্বস্তি অনুভব করে, জ্বর আসতে পারে, এবং অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ ঘটে। তারা হাতের কাছে যা পায়, তা কামড়াতে চায়, যা এই অবস্থার একটি সাধারণ উপসর্গ।
  2. ঠান্ডা–সর্দি বা অ্যালার্জি: শিশুদের ঠান্ডা বা সর্দি লাগলে তাদের নাক দিয়ে পানি পড়তে থাকে এবং শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, যা লালা নিঃসরণ বাড়াতে পারে। অ্যালার্জি থেকেও এটি হতে পারে।
  3. স্নায়ুর সমস্যা: ফেসিয়াল নার্ভ, সেরিব্রাল পালসি, বা ট্রাইজেমিনাল নার্ভের সমস্যা থাকলে লালা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হতে পারে, যার ফলে অতিরিক্ত লালা পড়তে পারে।
  4. মুখের ক্ষত বা সংক্রমণ: মুখের ভিতরে কোনো ক্ষত, সাইনাসের সমস্যা, বা টনসিলে প্রদাহ থাকলেও অতিরিক্ত লালা পড়তে পারে।
  5. লোভনীয় বা টকজাতীয় খাবার: টক বা অম্ল জাতীয় খাবার দেখলে বা খেলে লালা নিঃসরণের পরিমাণ বাড়তে পারে।
  6. জিবের অস্বাভাবিকতা: জিব বা ঠোঁটের সমস্যা যেমন ঠোঁট বন্ধ না হওয়া, ঠোঁট ও তালুকাটার সমস্যা, বা বদভ্যাস (যেমন মুখ খোলা রেখে থাকা) থেকেও অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ হতে পারে।
  7. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে লালা বাড়তে পারে।
  8. গ্যাস্ট্রিক সমস্যা: গ্যাস্ট্রিক বা পেটের সমস্যা থাকলে, বিশেষ করে খাবার হজমে সমস্যা হলে, লালা নিঃসরণ বেড়ে যেতে পারে।
  9. দাঁতের নতুন ফিলিং: নতুন ফিলিং করা দাঁতেও লালা নিঃসরণের পরিমাণ বাড়তে পারে।
  10. বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু: বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যেতে পারে।

এমন অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ এটি কখনো কখনো underlying কোনো শারীরিক বা স্নায়ুবিক সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।

অতিরিক্ত লালা নিঃসরণের কিছু শারীরিক এবং মানসিক পরিণতি হতে পারে, যেগুলো শিশুর জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এর মধ্যে কিছু সাধারণ সমস্যা হলো:

  1. সামাজিকভাবে বিব্রত হওয়া: অতিরিক্ত লালা পড়া শিশুর আত্মবিশ্বাসে প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে তারা সামাজিক পরিস্থিতিতে বিব্রত বোধ করতে পারে। মানসিক চাপ অনুভব করা, সহপাঠী বা বন্ধুদের দ্বারা এড়িয়ে চলা, এমনকি তাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে।
  2. ঠোঁটের চারদিকে প্রদাহ ও সংক্রমণ: অতিরিক্ত লালা পড়লে ঠোঁটের চারদিকে বিশেষ করে দুই কোনায় ভেজা অবস্থায় প্রদাহ, সংক্রমণ, বা ত্বকের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
  3. দুর্গন্ধ ও দাগ: মুখ এবং কাপড়ে অতিরিক্ত লালা পড়লে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হতে পারে, এবং এটি কাপড়ে দাগও লাগাতে পারে, যা শিশুর জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে।
  4. কথা বলা বা হাসি, উচ্চারণের সমস্যা: কথাবার্তা, হাসি, বা উচ্চারণের সময় লালা বেরিয়ে আসা, যা কথোপকথনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং শিশুকে অস্বস্তি দিতে পারে।
  5. খাবার গ্রহণের সময় সমস্যা: খাবার খাওয়ার সময় অতিরিক্ত লালা বেরিয়ে আসা, গিলতে সমস্যা হওয়া বা অপুষ্টি সৃষ্টি হতে পারে। খাবার গিলতে না পারলে শিশু পর্যাপ্ত পুষ্টি পেতে সমস্যা হতে পারে।
  6. শ্বাসতন্ত্রে লালা ঢুকে কাশি ও নিউমোনিয়া: কখনো কখনো অতিরিক্ত লালা শ্বাসতন্ত্রে ঢুকে কাশি সৃষ্টি করতে পারে এবং এটি ইনফেকশন সৃষ্টি করে নিউমোনিয়ার মতো গুরুতর রোগের কারণ হতে পারে।
  7. গলার কাছে লালা জমে শ্বাস নিতে অসুবিধা: লালা গলার কাছে জমে গেলে শ্বাস নেওয়ার সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, যা শিশুর জন্য শ্বাসপ্রশ্বাসে অসুবিধা সৃষ্টি করে এবং এটি বিপজ্জনক হতে পারে।

এ ধরনের সমস্যা যদি শিশুর দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

  1. ডেন্টাল চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া: শিশুর সমস্যার সঠিক কারণ নির্ধারণ করতে ডেন্টাল চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি। এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।
  2. অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ হয় এমন খাবার থেকে বিরত থাকা: কিছু খাবার, যেমন টক বা অম্লীয় খাবার, অতিরিক্ত লালা নিঃসরণের কারণ হতে পারে। এগুলি এড়িয়ে চলা উচিত।
  3. মাথা ও ঘাড়ের সঠিক পজিশন রাখা: যে অবস্থানে শিশুর অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ হয়, সে অবস্থান থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে। মাথা ও ঘাড় সঠিকভাবে রাখার অভ্যাস করাতে হবে।
  4. মুখের পরিচর্যা: মুখের পরিচর্যায় কোনো অবহেলা করা উচিত নয়। নরম টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা এবং ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ।
  5. অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ: শিশুকে চুষনি বা আঙুল চোষা, অত্যধিক টিভি/ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা উচিত, কারণ এসব অভ্যাসও লালা নিঃসরণের পরিমাণ বাড়াতে পারে।
  6. ডিহাইড্রেশন রোধে: শিশুকে পর্যাপ্ত পানি পান করাতে হবে। পাশাপাশি আদা চিবানো, পেঁপের জুস পান করানোও সাহায্য করতে পারে।
  7. স্পিচ থেরাপি ও মেডিকেশন: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে স্পিচ থেরাপি বা প্রয়োজনে মেডিকেশন গ্রহণ করা হতে পারে।

এছাড়া, ডেন্টাল সেন্টারের চিকিৎসক ডা. মো. আসাফুজ্জোহা রাজের মতামত অনুযায়ী এসব ব্যবস্থাগুলি শিশুর জন্য সহায়ক হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *