
মাত্র ৯ বছর আগেও সৌদি আরবের রাজনীতিতে মোহাম্মদ বিন সালমানের নাম তেমন কেউ শোনেননি। অথচ আজ তিনি সৌদি আরবের অবিসংবাদিত নেতা, যিনি একাধারে আলোচিত ও সমালোচিত। তার ক্ষমতা দখলের পথটি ছিল অত্যন্ত নাটকীয় এবং বিতর্কে পূর্ণ।
তৎকালীন বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর সৌদি আরবের নতুন বাদশাহ হন সালমান বিন আবদুল আজিজ। প্রথমে তিনি তার সৎভাই মুকরিনকে যুবরাজ হিসেবে নিয়োগ দিলেও মাত্র তিন মাসের মধ্যেই সেই সিদ্ধান্ত বদলে যায়। মুকরিনকে সরিয়ে নতুন যুবরাজ হন মোহাম্মদ বিন নায়েফ, আর মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) হন ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
এই পদ পাওয়ার পর থেকেই এমবিএস রাজপ্রাসাদে তার ক্ষমতা বাড়াতে শুরু করেন। তিনি তার বাবা বাদশাহ সালমানের ওপর ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন, এমনকি বাবাকে তার স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকেও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। বাবার নিরাপত্তা ও নজরদারিতে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
২০১৫ সালের ২০ জুন, পবিত্র রমজান মাসে রাজপরিবারের সদস্যরা মক্কায় একত্রিত হন। এ সময় যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে বাদশাহ সালমানের কক্ষে ডাকা হয়। লিফটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহরক্ষীদের অস্ত্র ও ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয় এবং তাকে গৃহবন্দি করা হয়। নায়েফ, যিনি ডায়াবেটিকসে ভুগছিলেন, তাকে রাতে ওষুধ না দিয়ে চাপের মুখে ফেলে পরের দিন সকালে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়। এই পুরো নাটকীয় দৃশ্য সৌদি টিভির মাধ্যমে বারবার প্রচার করা হয়।
নায়েফকে সরিয়ে দেওয়ার পর এমবিএসকে যুবরাজ ঘোষণা করা হয়। এরপরই তিনি বিনিয়োগ, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবসহ ক্ষমতার সবকিছু নিজের হাতে তুলে নেন। তার বিলাসবহুল জীবনযাপন, যেমন ৪৪০ ফুট লম্বা ইয়ট ও দা ভিঞ্চির চিত্রকর্ম কেনা, তার ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে, ভাইদের আটক করা, বাবাকে গৃহবন্দি করা, এবং ইয়েমেনে ভয়াবহ সামরিক হামলা চালানো। এছাড়া, সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে নৃশংসভাবে হত্যার অভিযোগ তার আন্তর্জাতিক সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সিআইএ’র তদন্তে বলা হয়, এই হত্যার নির্দেশ স্বয়ং যুবরাজই দিয়েছিলেন।
সংস্কার নাকি স্বৈরতন্ত্র?
২০১৮ সালে তিনি নারীদের ‘আবায়া’ পরার বাধ্যবাধকতা শিথিল করেন এবং তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স অনুমোদন দেন। অনেকে এটিকে সংস্কার বললেও সমালোচকরা মনে করেন, এটি ছিল মূলত অর্থনৈতিক কারণে নেওয়া একটি পদক্ষেপ।
ক্ষমতায় আসার পর এমবিএস রাজপরিবারের ঐতিহ্য ভেঙে ‘শূরা’ (পরামর্শপ্রথা) অমান্য করে নিজেকে একমাত্র শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি রাজপরিবারের প্রায় ৩৮০ জন সদস্য, ব্যবসায়ী এবং জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেন।
আজ মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের ক্ষমতার একক প্রতীক। বিশ্লেষকদের কেউ তাকে ‘দূরদর্শী সংস্কারক’ বলছেন, আবার কেউ বলছেন ‘স্বৈরশাসক’। তার এই উত্থান রাজতন্ত্রের ইতিহাসে এক নতুন এবং বিতর্কিত অধ্যায় তৈরি করেছে।